দেশের গরুর খামারগুলোয় দিন দিনই ছড়িয়ে পড়ছে লাম্পি স্কিন ডিজিস (এলএসডি)। পশু চিকিৎসকরা বলছেন, ভাইরাসজনিত এ রোগ মশা-মাছি ও কীটপতঙ্গের মাধ্যমে গরু-মহিষের শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। আক্রান্ত পশুর দেহের তাপমাত্রা ১০৩-১০৫ ডিগ্রিতে গিয়ে ওঠে। প্রচণ্ড জ্বরের কারণে খাওয়া বন্ধ করে দেয়। পাশাপাশি গায়ে দেখা দেয় বসন্তের মতো গুটি গুটি চাকা। সেখানে পুঁজ জমে ফেটে গিয়ে খসে পড়ে মাংস।

সেই সঙ্গে পা ফোলা, খোঁড়া হয়ে যাওয়া, কাজ করার ক্ষমতাও কমে যায়। এমনকি গরু ও মহিষ প্রায়ই এ রোগের কারণে গর্ভপাতের শিকার হয়। কমে যায় দুধ উৎপাদনও। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, দেশে এখন পর্যন্ত কয়েক লাখ গরু-মহিষ লাম্পি রোগে আক্রান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে মৃত্যু হয়েছে কয়েকশ গরুর, গর্ভপাতের সংখ্যা তারও কয়েক গুণ। সব মিলিয়ে অর্থনীতিতে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ক্ষতির শঙ্কা হাজার কোটি টাকা, যা এ খাতের জন্য অশনিসংকেত। রোগটির পর্যাপ্ত প্রতিষেধক ও চিকিৎসা না থাকায় দুশ্চিন্তায় রয়েছেন খামারিরা।

আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ায় ১৯২৯ সালে প্রথম গরুর এলএসডি শনাক্ত হয়। ১৯৪৩-৪৫ সালের মধ্যে সেটি মহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। ওই সময়ের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা, বতসোয়ানা, মোজাম্বিকসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোয় আক্রান্ত হাজার হাজার গরুর মৃত্যু হয় এবং বন্ধ হয়ে যায় শত শত খামার। পরে সত্তর ও আশির দশকে আফ্রিকার প্রায় সব দেশের গরুই এ রোগে আক্রান্ত হয়। আর এতে খামার ব্যবসায় ধস নামে। বর্তমানে সেখানে লাম্পি স্কিন রোগে পশুর গড় মৃত্যুহার ৪০ শতাংশ। তবে রোগটি দেশে প্রবেশ করেছে প্রতিবেশী ভারত থেকে। দেশটির ওড়িশা ও অন্ধ্র প্রদেশে প্রথম গরুর দেহে লাম্পি ভাইরাসের দেখা মেলে।

চলতি বছরও ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে লাম্পি ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ৬৭ হাজারেরও বেশি গরুর মৃত্যু হয়েছে। সবচেয়ে বেশি ভয়বহ অবস্থা রাজস্থানে। পাকিস্তান সীমান্তবর্তী উত্তরের এ রাজ্যে সরকারি হিসাবে ৪০ হাজারের মতো গরুর মৃত্যু হয়েছে চামড়াজনিত এ রোগে। যদিও বাস্তব পরিস্থিতি এর চেয়ে খারাপ বলে জানিয়েছে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমগুলো। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয়ও প্রকট আকার ধারণ করেছে লাম্পি ভাইরাস। প্রায় প্রতিদিনই নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে গরুর এ মরণঘাতী রোগ।

ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার দোহারো গ্রামের শাহানারা খাতুন। এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে কিনেছিলেন একটি গরু। আশা ছিল সেটিকে বড় করে অভাবের সংসারে কিছুটা সচ্ছলতা ফেরাবেন। কিন্তু কয়েকদিন আগে প্রিয় গরুটি লাম্পি রোগে আক্রান্ত হয়। টাকা-পয়সা খরচ করে চিকিৎসা করালেও শেষ পর্যন্ত আর বাঁচানো যায়নি। কান্নাজড়িত কণ্ঠে শাহানারা খাতুন বলেন, ঋণের টাকায় কেনা আমার গরুও গেল, দেনাও বাড়ল। এখন এনজিওকে নিয়মিত কিস্তি পরিশোধ করা যেন গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু আমিই নই, গ্রামের অনেকেরই আমার মতো অবস্থা।

খামারিরা জানান, চিকিৎসা খরচ কম হলেও লাম্পিতে গরুর স্বাস্থ্যহানির পাশাপাশি কমে যায় দুধ উৎপাদন। বর্তমানে দেশে এক লাখ গাভী লাম্পিতে আক্রান্ত। এ রোগে ভুগলে সেই গাভীর দুধ দুই মাস পর্যন্ত অর্ধেকে নেমে আসে। অর্থাৎ খামারের একটি গাভী দৈনিক গড়ে ১০ কেজি দুধ দিলেও আক্রান্তের পর মেলে পাঁচ কেজি। সেই হিসাবে দুই মাসে ৩০০ কেজি দুধ কম মেলে, যার বাজারমূল্য কেজিপ্রতি ৫০ টাকা ধরে ১৫ হাজার টাকা।

পাশাপাশি চিকিৎসা ও পুষ্টিকর খাবার বাবদ গড়ে আরো হাজার দশেক টাকা খরচ হয়। অর্থাৎ একটি গরুর ক্ষেত্রে লোকসান ২৫ হাজার টাকার মতো। সব মিলিয়ে লোকসানের পরিমাণ কয়েকশ কোটি টাকা। এর বাইরে গর্ভপাত ও মৃত্যুজনিত ক্ষতি তো আছেই। তবে লাম্পিতে বেশি ক্ষতি হয় ষাঁড়ের, ৩০ কেজি পর্যন্ত ওজন কমে যায়। সঠিক চিকিৎসায় দুই মাসের মধ্যে গরু সুস্থ হলেও স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।

এছাড়া আক্রান্ত বেশির ভাগ গরুর চামড়াও হয়ে পড়ে মূল্যহীন। আবার গায়ে দাগ পড়ায় সৌন্দর্যও নষ্ট হয়। ফলে অন্য পশুর চেয়ে অনেক কম দাম মেলে। এতেও লোকসানের পরিমাণ দাঁড়াবে কয়েকশ কোটি টাকা। বিষয়টি নিয়ে বেশ আতঙ্কিত এ খাতের ব্যবসায়ীরাও। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ বলেন, চামড়ায় গোটা বা দাগ থাকলে ক্রেতারা কেনে না। এর আগে অ্যানথ্রাক্সে আক্রান্ত হওয়া গরুর চামড়াও আমরা এ কারণে কিনতে পারিনি। তবে দু-একটি ছোট কারখানা স্থানীয় বাজারের জন্য এসব চামড়া কিনলেও দাম খুবই কম।

বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক শাহ ইমরান বলেন, লাম্পি স্কিন ডিজিস এখনো কিছু কিছু রিজিয়নে রয়েছে। এটার জন্য প্রোপার ভ্যাকসিনও রয়েছে। তাই মহামারী থেকে রক্ষায় রোগটাকে এখনই প্রতিকারের জন্য সরকারকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে দেশের খামারিরা ক্ষতিগ্রস্ত না হন। দেশে যারা গবাদিপশু খামারের সঙ্গে জড়িত তাদের প্রায় ৯৫ শতাংশই আর্থিকভাবে সচ্ছল নন।

সুতরাং গ্রামেগঞ্জে যারা আছেন, তাদের ভ্যাকসিনগুলো ফ্রি দিতে হবে। এ রোগ নির্মূল করতে সরকারকে ক্যাম্পেইন করতে হবে। কারণ আমাদের দেশের মানুষজন এসব রোগ সম্পর্কে এখনো তেমন জানে না, বোঝে না। এজন্য সচেতনতা দরকার। দেশে গরু রয়েছে ২ কোটি ৪০ লাখের বেশি। এর মধ্যে ৫০ জেলায় সাড়ে তিন লাখের বেশি পশু লাম্পি স্কিনে আক্রান্ত। অনেক খামারি স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়ায় এর সঠিক তথ্য অবশ্য সরকারের জানা নেই।

আবার সারা দেশে এ পর্যন্ত কতসংখ্যক গবাদিপশু লাম্পি রোগে আক্রান্ত হয়েছে সে হিসাবও এখনো চূড়ান্ত করতে পারেনি প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর। যদিও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে এখন পর্যন্ত অন্তত সাড়ে তিন লাখ গবাদিপশু এ রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে তথ্য এসেছে। এর মধ্যে ঝিনাইদহের ছয় উপজেলায় অন্তত ১০ হাজার গরু আক্রান্ত হয়েছে। আর মৃত্যু হয়েছে অর্ধশতাধিক।

পাশের জেলা মেহেরপুরের পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ। প্রায় প্রতিটি খামার ও কৃষকের গরু লাম্পি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। মৃত্যুর সংখ্যাও নেহাত কম নয়, শতাধিক। মেহেরপুর সদর উপজেলার পিরোজপুর গ্রামের খামারি সুমন মিয়া জানান, তার খামারে সাতটি গরুর আছে। এর মধ্যে তিনটি গরু এক মাস আগে লাম্পি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়। স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা করে মোটামুটি সুস্থ হলেও পায়ে ও বুকে এখনো ক্ষত রয়ে গিয়েছে।

গরুগুলো খাবার কম খায়, শুয়ে শুয়ে কেবল ঝিমায় এবং ক্ষত স্থান দিয়ে রক্ত ও পুঁজ ঝরে। তবে চিকিৎসকরা বলছেন, দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবে আক্রান্ত গরুগুলো। ঝিনাইদহ জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মনোজিৎ কুমার সরকার জানান, লাম্পি যেন ছড়িয়ে না পড়ে সেজন্য পরামর্শের পাশাপাশি তারা ভ্যাকসিনেশন কার্যক্রম চালু রেখেছেন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, বাংলাদেশে গরুর লাম্পি স্কিন রোগ প্রথম দেখা যায় ২০১৯ সালে, চট্টগ্রামে। রোগটি সাধারণত গ্রীষ্মের শেষ ও বর্ষার শুরুতে মশা-মাছির বিস্তারের সময় ব্যাপক আকার ধারণ করে। আক্রান্ত পশু মারা যাওয়ার হার ১-৩ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) ডা. মোহাম্মদ রেয়াজুল হক বলেন, ভাইরাসজনিত রোগটি মশা-মাছির সাহাহ্যে ছড়ায়। এখন যেহেতু বর্ষাকাল তাই রোগের প্রকোপ রয়েছে। তবে শীতে একদম থাকে না। আবার এপ্রিলে শুরু হয়।

লাম্পি তেমন গুরুতর রোগ নয়।চিকিৎসাও লাগে না। এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। যদি ব্যথা থাকে তবে পশুকে কেবল প্যারাসিটামল খাওয়ালেই হয়। আর ঘা হলে মলম দিলেই সেরে যায়। এমনকি কোনো পশুর একবার লাম্পি হলে সেটির আর আক্রান্তের সম্ভাবনা থাকে না। বর্তামানে গোটপক্স ভ্যাকসিন দেয়া হচ্ছে। আমরা সবসময় এসব বিষয়ে প্রস্তুত থাকি।

রোগটি প্রতিরোধে অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মাঠে আছেন। পর্যাপ্ত ভ্যাকসিন ও ওষুধ সরবরাহ করা হচ্ছে। বৃষ্টি ও বর্ষা কমে গেলে দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে। আক্রান্ত পশুও সুস্থ হয়ে উঠবে। তাই এটা নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই। পশুবিজ্ঞানীরা বলছেন, এ রোগের সবচেয়ে বড় প্রতিষেধক আক্রান্ত গরুকে আলাদা করে রাখা, খামার পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা এবং খামারে মশারি ব্যবহার করা।

সাধারণত আক্রান্ত গরুর প্রথমে জ্বর আসে। এছাড়া শরীরে বড় বড় গোটা উঠতে থাকে। এমন দেখা গেলে আতঙ্কিত না হয়ে গরুকে আলাদা করে রেখে প্যারাসিটামল খাওয়াতে হবে। আবার আক্রান্ত গরুকে যেহেতু প্রতিষেধক দেয়া হয় না, তাই সনাতনী পদ্ধতি খুব একটা খারাপ নয়। বিভিন্ন জেলায় নিমপাতা, বাসক পাতাসহ কর্পূর ও অন্যান্য কবিরাজি চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের প্যাথলজি বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক ড. মো. মকবুল হোসেন বলেন, লাম্পি হচ্ছে পক্সের একটা মডিফায়েড রোগ। প্রধানত বর্ষার শেষে, শরতের অথবা বসন্তের শুরুতে যে সময়ে মশা-মাছি অধিক বংশবিস্তার করে সে সময়ে প্রাণঘাতী এ রোগ ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়ে।

যেহেতু এ নিয়ে কোনো স্টাডি নেই, তাই বিভিন্ন লক্ষণের বিপরীতে আলাদাভাবে চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সমস্যা অনুযায়ী চিকিৎসা দেয়া হচ্ছে। কিন্তু প্রপার কোনো চিকিৎসা নেই। আমাদের দেশে এর কোনো ভ্যাকসিনও নেই। তবে গোটপক্স ভ্যাকসিন দিয়ে কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা যেতে পারে।

এদিকে আক্রান্ত গরুর মাংস বা দুধ পান করলে মানবদেহের কোনো ক্ষতি হয় না বলে জানিয়েছেন প্রাণিরোগ বিশেষজ্ঞরা। এমনকি এসব গরুকে কামড়ানো মশা যদি মানুষকে কামড়ায় তাহলেও লাম্পিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। ওয়ার্ল্ড অর্গানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ (ডব্লিউওএএইচ) বলছে, রোগটি জুনোটিক নয়। ফলে এটি প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে ছড়ায় না।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেটেরিনারি অনুষদের মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড হাইজিন বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল কাফি বলেন, গবাদিপশুর শরীর থেকে এলএসডি মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা নেই। তবে অন্য প্রাণীর দেহে তা ছড়াচ্ছে কিনা তা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ জরুরি। আর যেসব প্রাণী আক্রান্ত হয়েছে সেগুলোকে দ্রুত চিকিৎসা এবং যেগুলো আক্রান্ত হয়নি সেগুলোকে টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। কেননা একটা খামারকে অর্থনৈতিকভাবে ধসিয়ে দেয়ার জন্য এফএমডি বা খুরা রোগের চেয়ে অনেক বেশি ভয়ংকর হিসেবে ধরা হয় এলএসডিকে।

তথ্যসূত্র: বণিক বার্তা।